ডা:ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেড্রিক স্যামুয়েল হ্যানেমান
|
আজ থেকে দুশ বছর পূর্বে হ্যানিম্যানের সময় এলোপ্যাথিক চিকিৎসা ছিল চরম বর্বরতার সমতুল্য। তখনকারদিনের এলোপ্যাথিক ডাক্তাররা উচ্চ রক্তচাপসহ অধিকাংশ রোগের চিকিৎসার জন্যই রোগীর শরীরে অনেকগুলো জোঁক লাগিয়ে দিতো রক্ত কমানোর জন্য অথবা রগ কেটে রক্ত বের করত, মানসিক রোগীকে ভুতে ধরেছে মনে করে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলত, একটি রোগের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে পনের থেকে বিশটি ঔষধ রোগীকে একত্রে খাওয়ানো হতো, সামান্য থেকে সামান্য ব্যাপারেও শরীরে ছুরি চালানো হতো ইত্যাদি ইত্যাদি।হ্যানিম্যান কিন্তু অন্যান্য ডাক্তারদের মতো ডাক্তারী পাশ করে অর্থ উপার্জনের পেছনে লেগে যান নাই; বরং চিকিৎসার নামে এসব বর্বরতা থেকে মানবজাতিকে কিভাবে মুক্ত করা যায় তা নিয়ে যুগের পর যুগ গবেষণা করেছেন।এজন্য তাকে অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, অপমান-লাঞ্ছনা, হুমকি-ধামকি, দেশ থেকে বহিষ্কার প্রভৃতি অনেক অনেক ভোগানি- সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু তার পরও তিনি পিছপা হননি।ফলে রোগের উৎপত্তি, রোগের বিকাশ, রোগের চিকিৎসা,ঔষধ আবিষ্কার, ঔষধ পরীক্ষাকরণ, ঔষধ প্রস’ত প্রণালী,ঔষধের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি এমন অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হন ;গত দুইশ বছরেও যার চাই উৎকৃষ্ট কিছু আবিষ্কার করা কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব হয় নাই। তিনি এমন একটি চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছিলেন যাতে বাদশা থেকে ভিক্ষুক কাউকেই টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে না হয়।ডাক্তারদের মধ্যে পেশাগত অহমিকা, লোভ, হিংসা ইত্যাদি যে কত বেশী মাত্রায় আছে, তার প্রমাণ হলো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবিষ্কার। রোগীকে কম কষ্ট দিয়ে, কম খরচে এবং কম সময়ের মধ্যে রোগ নিরাময়ের স্বার্থে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অমূল্য আবিষ্কারকে যেখানে সকল চিকিৎসকের সাদরে গ্রহন করা উচিত ছিল, সেখানে দেখা গেছে বেশীর ভাগ ডাক্তারই হ্যানিম্যানের এই অমূল্য আবিষ্কারকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞান এলোপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথি নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ইউরোপে এবং আমেরিকায় এলোপ্যাথিক ডাক্তাররা প্রথম যখন সমিতি গঠন করেছিল,তখন তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর বুক থেকে (একটি মানবতাবাদী চিকিৎসা বিজ্ঞান) হোমিওপ্যাথিকে নিশ্চিহ্ন করা।
বাণিজ্যের কাছে সেবাধর্ম কিভাবে পরাজিত হয়,এসব ইতিহাস সবারই জানা থাকা উচিত।মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ১৭৫৫ সালের ১১ই এপ্রিল জার্মানীর স্যাক্সোনি প্রদেশের মেইসেন শহরে জন্মগ্রহন করেন, যার অবস্থান ড্রিসডেন শহরের বিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে (পোল্যান্ড এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার বর্ডারের কাছে) তাঁর পুরো নাম ছিল ক্রিস্টিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (Christian Friedrich Samuel Hahnemann)। তাঁর পিতার নাম ছিল ক্রিস্টিয়ান গটফ্রাইড হ্যানিম্যান এবং মাতার নাম ছিল জোহান্না ক্রিস্টিয়ানা। তৎকালে মেইসেন শহরটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর কেননা ইহার চার হাজার অধিবাসীর অধিকাংশই ছিল দক্ষ শিল্পী, রসায়নবিদ এবং চিত্রকর। তাছাড়া এই শহরে ছিল একটি বিজ্ঞান একাডেমী, অনেকগুলো কাপড়ের কারখানা এবংছিল তখনকার দিনের নতুন আবিষ্কার চীনা মাটির আসবাপত্রের একটি ফ্যাক্টরী।সিরামিকের এই কারখানাটি ছিল পুরনো পরিত্যক্ত একটি রাজ প্রসাদে অবসি’ত। হ্যানিম্যানের পিতা চীনা মাটির থালা-বাসনের ওপর ছবিএঁকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই সব দিনে সিরামিকের তৈজষপত্রে রঙ এবং স্বর্ণ দিয়ে নক্সা করা এবং ছবি আঁকা ছিল একটি নতুন আবিষ্ককৃত প্রযুক্তি এবং এই কাজে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হতো তাদেরকে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে গোপনীয়তা রক্ষার অঙ্গীকার করানো হতো। হ্যানিম্যানের পিতা ছিলেন একজন সৎ, বিচক্ষণ এবং ধার্মিক ব্যক্তি। ফলে ভালো এবং মন্দ, পাপ এবং পুণ্য, সরলতা এবং কুটিলতা ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তিনি হ্যানিম্যানের মনে দৃঢ়ভাবে গেথে দিয়েছিলেন। হ্যানিম্যান ছিলেনতাঁর পিতা-মাতার পাঁচ সনতানের মধ্যে তৃতীয় এবং পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। শিশুকাল থেকেই তিনি পড়াশুনায় অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন বিশেষত ভাষা এবং বিজ্ঞানে।
তিনি ইংরেজী, ফরাসী, গ্রিক, ল্যাটিন, সপ্যানিশ এবং আরবী ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। সেকালে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরব দেশীয় মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের (ইবনে সীনা, ফারাবী, আল কিন্দি প্রভৃতি) লেখা পুস্তকসমূহ পড়ানো হতো; ফলে কারো পক্ষে সত্যিকারের চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য আরবী ভাষা শেখা ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। এমনকি মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর ওসতাদের নির্দেশে হ্যানিম্যান তাঁর সহপাঠিদের গ্রীক ভাষা শিক্ষা দিতেন।বলা হয়েছে বিজ্ঞান এবং গবেষণার দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল জন্মগত ; একেবারে মজ্জাগত। পাবলিক স্কুলে পড়াকালীন সময়ে মাস্টার মুলার নামক একজন যথার্থ যোগ্য শিক্ষকের স্নেহ লাভে ধন্য হন যিনি তাকে দৈনন্দিন পাঠ মুখসত না করে হজম করার পরামর্শ দিতেন। যোগ্যতা এবং দক্ষতার কারণে তিনি হ্যানিম্যানকে গ্রিক ভাষার ক্লাশ নিতে অনুমতি দিতেন। ফলে সহপাঠিরা হ্যানিম্যানকে ভালোবাসতো। অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে হ্যানিম্যান মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়তেন এবং তখন এই মহান শিক্ষক তাঁর হোমওয়ার্ক,টিউটোরিয়াল ইত্যাদি মাফ করে দিতেন। হ্যানিম্যানের জন্য তাঁর দরজা ছিল সারাক্ষণ খোলা ; যে-কোন সময় তিনি শিক্ষকের সাহায্য লাভ করতেপারতেন।হ্যানিম্যানের পিতা প্রায়ই তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতেন, তাড়াতাড়ি আয়-রোজগার করা যায় এমন কোন পেশায় নিযুক্ত করার জন্য। মাস্টার মুলার তাঁর পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য বিদ্যালয়ের ফি পযর্ন্ত মওকুফ করে দিয়েছিলেন প্রায় আট বছর এবং নানানভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে-অনুরোধ করে হ্যানিম্যানকে রেখে তাঁর পিতাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
১৭৭৫ সালে হ্যানিম্যান পিতার কাছ থেকে কুড়িটি মুদ্রা (thalers) নিয়ে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।পিতার হাত থেকে নেওয়া এটাই ছিল তাঁর সর্বশেষ টাকা-পয়সা। এজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না ; কেননা তার আরো অনেক সন্তানাদি ছিল এবং তার যৎসামান্য আয়-রোজগার দিয়ে সকলের জন্য শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
১৭৭৫ সালে তিনি লিপজিগ ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানকার অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার কারণে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন ; কেননা সেই ডিপার্টমেন্টের অধীনে না ছিল কোন ক্লিনিক, না ছিল কোন হাসপাতাল। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি অর্থের বিনিময়ে ইংরেজী থেকে জার্মানীতে পুস্তক অনুবাদের খন্ডকালীন কাজ হাতে নেন এবং একজন ধনী গ্রীক ব্যক্তিকে ফরাসী ভাষা শেখাতেন। ফলে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারতেন না। ১৭৭৭ সালের প্রথমার্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে এবং বাসতব অভিজ্ঞতা লাভের নিমিত্তে তিনি ভিয়েনা গমণ করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আর্থিক অনটন এবং ডাকাতদের হাতে লুন্ঠিত হওয়ার কারণে নয় মাসের মাথায় কোর্স অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তবে রয়েল কলেজের একজন অধ্যাপক হ্যানিম্যানের প্রতিভায় এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাকে রোমানীয়ার গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং গ্রন্থাগারের লাইব্রেরীয়ান হিসেবে তিনি গভর্নরের প্রাচীন মুদ্রার কালেকশান, পুরনো পুস্তকসমূহ এবং পান্ডুলিপিসমূহের একটি ক্যাটালগ তৈরী করে দেন, যা ছিল রসায়ন শাসত্র এবং যাদুবিদ্যার উপর ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং দুর্বল পান্ডুলিপির লাইব্রেরী। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি কয়েকটি ভাষা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সমপর্কিত কয়েকটি বিজ্ঞান বিষয়ে পান্ডিত্যঅর্জন করেন।
তিনি আরলেঙ্গেন ইউনির্ভার্সিটিতে তাঁর শেষ সেমিষ্টার অধ্যয়নের পর পেশীর আক্ষেপের (Cramps) ওপর একটি থিসিস পেপার জমা দেন এবং চিকিৎসক হিসেবে এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। আরলেঙ্গেন ইউনির্ভাসিটি থেকে তাঁর রেজিস্ট্রেশন লাভের পেছনের কারণ ছিল একটাই আর তা হলো তিনি জানতে পেরেছিলেন যে আরলেঙ্গেনের ফি সবচেয়ে কম। ১৭৮১ সালে তিনি ম্যান্সফিল্ডের তামার খনি এলাকার নিকটবর্তী একটি গ্রামের ডাক্তারের চাকুরি নেন। ১৭৮০ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্যে তিনি চিকিৎসক হিসেবে বেশ কয়েকটি চাকুরিতে যোগদান করেন কিন্তু ১৭৮২ সালে তাঁর বিয়ের পর থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপূর্ণতা এবং ব্যর্থতা লক্ষ্য করে ডাক্তারী পেশার প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকেন।কেননা তিনি লক্ষ্য করেন যে, ঔষধের ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলে রোগীদের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অধিকাংশ রোগই ঔষধে নিরাময় হয় না, যে-রোগ তিনি সারিয়ে দিচ্ছেন একই রোগ নিয়ে কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর পরে রোগীরা পুণরায় ফিরে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে ১৭৮৪ সালে ড্রিসডেন শহরে পৌঁছানোর পর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ডাক্তারী পেশা বর্জন করেন এবং তাঁর ক্রমবর্ধিষ্ণু পরিবারের সৎ উপায়ে ভরণপোষনের জন্য পুণরায় ফুল-টাইম ভিত্তিতে অনুবাদকের পেশা গ্রহন করেন।
১৭৮২ সালের শেষের দিকে হ্যানিম্যান মিস কাচলারকে (spinster Johanna Henrietta Leopoldina Kuchler) বিয়ে করেন। হ্যানিম্যান তাঁর ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ জীবনে আকর্ষণীয়া এই তরুণীর মধ্যে যেন তাঁর অনন্তকালে প্রিয়াকে খুঁজে পান। হ্যানিম্যান তাকে সোহাগ করে ইলিজ (Elise) নামে ডাকতেন যা সত্রীর নিকট লেখা তাঁর অনেক পত্রে দেখা গেছে।
সেইন্ট জন-এর গীর্জার ম্যারিজ রেজিস্টারে উল্লেখ ছিল,“অদ্য পহেলা ডিসেম্বর ১৭৮২ সালে, সেন্ট জনস চার্চে,মিঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান,ডক্টর অব মেডিসিন, গুমেরানের (Gommern) স্থানীয় নির্বাচিত স্যাক্সন গীর্জা পল্লীর ডাক্তার,বয়স ২৮ বছর, মেসেনের সিরামিক ফ্যাক্টরীর চিত্রশিল্পী মিঃ ক্রিস্টিয়ান গটফ্রাইড হ্যানিম্যান এবং তার সত্রী জোহান্না ক্রিশ্চিয়ানার ঔরসজাত পুত্র, বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন প্রয়াত গটফ্রাইড হেনরী কুচলার এবং তার স্ত্রী মার্থা সোফিয়ার ঔরসজাত কন্যা মিস সিপনস্টার জোহান্না হেনরিয়েটা লিওপোল্ডিনা কাচলার-এর সাথে”। বিয়ের পর গুমারনেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ১৭৮৩ সালের শেষের দিকে অথবা ১৭৮৪ সালের প্রথম দিকে তাঁর প্রথম (কন্যা) সন্তান হেনরীয়েটা (Henrietta) জন্মগ্রহন করে।হ্যানিম্যান কেন এলোপ্যাথিক চিকিৎসক হয়েও এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছিলেন, এই সম্পর্কে একটু বিশদ ব্যাখা না করলে তাঁর জীবনী আলোচনা অসমাপ্তই থেকে যাবে। তৎকালে এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি এতই জঘন্যএবং বর্বরতায় পূর্ণ ছিল যে, হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বারকে কশাইখানা বলাই যুক্তিযুক্ত ছিল। সেখানে রোগীদেরকে রাখা হতো ভিজা এবং গরম কক্ষে, অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে দেওয়া হতো, দৈনিক কয়েকবার রোগীদের শরীর থেকে রক্ত বের করে ফেলে দিয়ে দুর্বল করা হতো, রোগীদের শরীরে জোঁক লাগিয়ে (Leeching), কাপের মাধ্যমে বা সিঙ্গা লাগিয়ে (cupping) অথবা রক্তনালী কেটে (venesection) রক্তপাত করা হতো, পায়খানা নরম করার ঔষধ (purgatives) খাওয়ানোর মাধ্যমে অনেক দিন যাবত রোগীদের পাতলা পায়খানা করানো হতো, বমি করানো হতো ইত্যাদি ইত্যাদি।
সিফিলিসের রোগীদের প্রচুর মার্কারী খাওয়ানোর মাধ্যমে লালা নিঃসরণ (salivation) করানো হতো এবং এতে অনেক রোগীই কয়েক বালতি লালা থুথু আকারে ফেলতো এবং অনেক রোগীর দাঁত পযর্ন্ত পড়ে যেতো। অধিকাংশ রোগী (চিকিৎসা নামের) এই কুচিকিৎসা চলাকালীন সময়েই মারা যেতো।শরীরের মাংশ অর্থাৎ টিস্যুকে গরম লোহা অথবা বাষ্প দিয়ে পুড়ানো হতো (cauterization),গরম সুঁই দিয়ে খুচিয়ে চামড়ায় ফোস্কা ফেলা হতো (blistering),লাঠি অথবা পাথরের আঘাতে শরীরে কৃত্রিম ফোঁড়া-ঘা-ক্ষত সৃষ্টি করা হতো এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ঘা-ক্ষত মাসের পর মাস বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হতো।উপরে বর্ণিত সকল কিছুই করা হতো জটিল রোগে আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসা বা রোগমুক্তির নামে যা আজকের দিনে কোন সুস’ মানুষের পক্ষে কল্পনারও বাইরে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোন গুরুত্বই ছিল না ; এমনকি অপারেশনের রুম ছিল অনেকটা গোয়াল ঘরের মতো।এই কারণে ছোট-খাটো অপারেশনের পরেও শতকরা ৫০ ভাগ রোগী ইনফেকশনের স্বীকার হয়ে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করতো।
হাসপাতালের ভেতরের গন্ধ ছিল লাশকাটা ঘরের গন্ধের মতো জঘন্য। মানসিক রোগীদেরকে শিকলে বেধে রাখা হতো, নিষ্টুরভাবে লাঠি দিয়ে তাদেরকে প্রহার করা হতো, বালতি দিয়ে তাদের শরীরে ঠান্ডা নিক্ষেপ করা হতো এবং আত্মীয়-স্বজনরা দেখতে এলে তাদেরকে জংলী জানোয়ারের মতো শিকলে বেধে টেনে হিচরে এনে দেখানো হতো।তৎকালে অর্থাৎ হ্যানিম্যানের সময় অষ্টাদশ শতাব্দিতে এলোপ্যাথিক মেডিক্যাল সাইন্সের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। কিন্তু ডাক্তাররা রোগীদের নিকট নিজেদেরকে খুবই জ্ঞানীগুণীরূপে জাহির করার জন্য একে অন্যের সাথে ল্যাটিন ভাষায় কথা বলতো ; এখনকার দিনের ডাক্তাররা যেমন রোগীদের সামনে ইংরেজী ভাষায় জটিল ডাক্তারী শব্দ ব্যবহার করে কথা বলে। এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে নানান রকম ফ্যাশন চালু আছে এবং কিছুদিন পরপর নতুন নতুন ফ্যাশন চালু করা হয়। এখনকার দিনের ফ্যাশন হলো মারাত্মক জটিল রোগীদের শরীরে রক্ত দেওয়া কিন্তু হ্যানিম্যানের যুগের ফ্যাশন ছিল উল্টো শরীর থেকে রক্ত বের করা ফেলা।অষ্টাদশ শতাব্দিতে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পড়ানো হতো (এবং সকল ডাক্তাররা বিশ্বাস করতো) যে, অধিকাংশ জটিল মারাত্মক রোগের কারণ হলো শরীরে তরল পদার্থের (অর্থাৎ খারাপ রক্তের) পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (superfluity/plethora)। ফলে কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে (রোগীর কল্যাণের স্বার্থে অর্থাৎ রোগমুক্তির জন্য) রগ কেটে (venesection) , শরীরে অনেকগুলো জোঁক লাগিয়ে অথবা সিঙ্গা লাগিয়ে শরীর থেকে (অপ্রয়োজনীয় খারাপ ?) রক্ত বের করে ফেলে (bloodletting) দেওয়া হতো। কোন ডাক্তার যদি মারাত্মক রোগের ক্ষেত্রে রক্ত বের করার চিকিৎসা না দিতো, তবে তাকে গণপিটুনি দেওয়া হতো এবং (বেচেঁ গেলে) অযোগ্যতার অভিযোগে তার সরকারী রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হতো। এমনকি মেডিকেল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে এমন কথাও লেখা ছিল যে, “জটিল সংকটাপন্ন রোগীকে যেই চিকিৎসক রক্ত বের করার চিকিৎসা না দিবে, সেই ডাক্তার চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মহা অপরাধী খুনী। দুনিয়াতে সে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেলেও আখেরাতে আল্লাহর নিকট থেকে নিশ্চয় কঠিন শাস্তি ভোগ করবে”।রোগীর অবস্থা যত সিরিয়াস হতো তার শরীর থেকে তত বেশী রক্ত ফেলে দেওয়া হতো। যেমন- একজন একসিডেন্টের রোগী যার শরীর থেকে এমনিতেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে মরণদশা হয়ে গেছে কিংবা একজন ডায়েরিয়া-কলেরার রোগী যিনি অনেক দিন পাতলা পায়খানা করে দুর্বল-রক্তশুণ্য হয়ে পড়েছে, তাদেরকেও (সুস্থ করার জন্য সাথে সাথে) শরীর থেকে রক্ত বের করে ফেলে দেওয়া হতো। অনেক সময় একই রোগীর শরীর থেকে দৈনিক তিন-চার বার করে রক্ত বের করা হতো। ফলে রক্তের অভাবে শরীর দুর্বল হয়ে অধিকাংশ রোগী মারা যেতো। রক্ত কমে গেলে যে শরীর দুর্বল হয়, রোগীর মৃত্যু আরো তাড়াতাড়ি হবে ; এতটুকু কাণ্ডজ্ঞানও ডাক্তারদের ছিল না কিংবা বলা যায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছিল না। এভাবে ঘনঘন রক্ত বের করে ফেলে দেওয়ার ফলে কতো রাজা, বাদশা, নবার, সম্রাট, পোপ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী যে ডাক্তারদের হাতে খুন হয়েছে, তার কোন সীমা নাই।চিকিৎসার নামে এসব অবৈজ্ঞানিক-অমানবিক কর্মকাণ্ড সস্পর্কে হ্যানিম্যান তাঁর অর্গানন (Organon of Medicine) নামক পুস্তকে ১৮১০ সালে লিখেছিলেন, “(রোগীর) শরীরকে অত্যাচার করে দুর্বল করার মাধ্যমে(রোগীকে) মৃত্যুর দুয়ারে পৌছেঁ দিয়ে আমরা কোন রোগমুক্তি আশা করতে পারি না। আর এখনও এই প্রাচীনপন্থী (এলোপ্যাথিক) ডাক্তাররা জানেন না জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের রোগমুক্ত করার জন্য কি করতে হবে ; কেবল তাদেরকে নিযার্তন করা, শক্তি ক্ষয় করা, তাদের জীবনবাহী(অতিপ্রয়োজনীয়) তরল পদার্থ (রক্ত) নষ্ট করা এবং আয়ু হ্রাস করা ছাড়া”।১৭৯২ সালে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় লিওপোল্ড চিকিৎসার নামে একই দিনে চার বার রক্তপাত করার কারণে ডাক্তারদের হাতে খুন হন। সম্রাট উচ্চ মাত্রার জ্বর এবং পেট ফোলা রোগে ভোগছিলেন। সে সময় হ্যানিম্যান ছিলেন ৩৭ বছরের একজন তরুণ এলোপ্যাথিক ডাক্তার। তা সত্ত্বেও হ্যানিম্যান নির্দিধায় সম্রাটের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে সমালোচনা করে পত্রিকায় লিখে পাঠান যে, “একবার রক্ত বের করার পরে যেহেতু সম্রাটের শারীরিক অবস’ার উন্নতি হয়নি, সেহেতু দ্বিতীয়বার রক্তপাত করা যুক্তিসঙ্গত হয়নি। এমনকি দ্বিতীয়বার রক্তক্ষরণ করার পরও যেহেতু সম্রাটের কোন উন্নতি হয়নি, সেহেতু তৃতীয়বার এবং চতুর্থবার কেন সম্রাটের শরীর থেকে রক্তপাত করা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান অবশ্যই সেই প্রশ্ন করবে।চিকিৎসার নামে এটি ঠান্ডা মাথায় খুন ছাড়া কিছুই নয়”। এমনকি ১৮৩২ সালে সারা ইউরোপজুড়ে যে ঐতিহাসিক কলেরার মহামারী দেখা দিয়েছিল, তখন হ্যানিম্যান (পাতলা পায়খানা এবং বমি করতে করতে) মরণাপন্ন দশায় পৌঁছে যাওয়া এসব কলেরা রোগীদের শরীর থেকে রক্ত বের না করার আহবান জানিয়ে একটি লিফলেট ছেড়ে ছিলেন। এবং ইহার প্রতিবাদে সারা ইউরোপের একশত বিখ্যাত এলোপ্যাথিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি লিফলেট ছাড়েন যাতে বলা হয়েছিল যে, “রক্তপাতই (bloodletting) কলেরার শ্রেষ্ট চিকিৎসা”।এসময় ড্রিসডেনেও তিনি একটু-আধটু ডাক্তারী করতেন, তবে তা জীবিকা অর্জনের জন্য ছিলো না বরং তা ছিলো প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অকার্যকারীতা এবং ক্ষতিকারক দিক নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে। ১৭৮৪ সালে তিনি Demarchy-র The Art of Manufacturing Chemical Products বইটি ফরাসী ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। এটি ছিল দুই খন্ডের একটি বিশাল অনুবাদ কর্ম যাতে তিনি নিজে থেকে অনেক কিছু যোগ করেছেন। এই কাজের জন্য স্বেচ্ছায় তাকে অনেক অভাব-অনটন সহ্য করতে হয়েছে এবং দারিদ্রের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হয়েছে। কেননা অনুবাদের কাজে তিনি খুবই সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। ডিমারকি ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ট রসায়নবিদ (chemists)। ফ্রেঞ্চ একাডেমী তার বইটি ছাপিয়েছিল যাতে জনগণ কেমিক্যাল দ্রব্যাদির উৎপাদন কৌশল আয়ত্ত করতে পারে। কেননা তৎকালে অধিকাংশ ক্যামিকেলের উৎপাদনকারী ছিল ওলন্দাজরা (Dutch) এবং বাণিজ্যিক কারণে তারা এসব ব্যাপারে খুবই গোপণীয়তা বজায় রাখতো।হ্যানিম্যানও বইটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে দেশবাসীর বিরাট উপকার করেছিলেন। বইটি অনুবাদের পাশাপাশি এতে তিনি নিজে থেকে অনেক তথ্য পাদটিকা আকারে সংযুক্ত করে দিয়েছেন, ত্রুটিগুলি সংশোধন করে দিয়েছেন, অসম্পূর্ণ তথ্যকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন ; যা পড়লে রসায়ন শাস্ত্রে এই তরুণ চিকিৎসকের অসাধারণ পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। antimonials, lead, quicksilver, camphor, succinic acid, borax ইত্যাদির ব্যাপারে তিনি দশজন লেখকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ডিমারকি যেখানে বলেছেন যে, carbonification of turf-এর ওপর কোন গবেষণার কথা তার জানা নেই, হ্যানিম্যান সেখানে ছয়টি গবেষণার উল্লেখ করেছেন। ডিমারকি একজন বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসকের কথা উল্লেখ করেছিলেন ; হ্যানিম্যান তার নাম, বইয়ের নাম এবং সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছদেরও উল্লেখ করেছেন। মোটামুটি বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠাতেই তার ফুটনোট চোখে পড়ে।
ক্যামিকেল ছাঁকন বা উত্তপ্ত করার পাত্র (retorts) তৈরীতে হ্যানিম্যান নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন ; যাতে মনে হয় বিভিন্ন দেশে কেমিকেল উৎপাদনের পদ্ধতির সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। রাশিয়া, সুইডেন, জার্মানী, ইটালি, সিসিলি প্রভৃতি দেশে এলুমিনিয়ামের (alum) ব্যবহারের বিষয়ে ডিমারকি’র ভুল তথ্যকে হ্যানিম্যান সংশোধন করে দেন। Annalen নামক একটি বিখ্যাত কেমিকেল সাময়িকীর সম্পাদক Crell লিখেছিলেন যে, “আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, রসায়ন শাস্ত্রের ওপর ইহার চাইতে উন্নত, পুর্ণাঙ্গ এবং প্রামান্য গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই”। ১৭৮৫ সালে ডিমারকির Art of Distilling Liquor নামক বইটিও হ্যানিম্যান অনুবাদ করে দুই খন্ডে প্রকাশ করেন।
১৭৮৪ সালে দুরারোগ্য ক্ষতের (scrofulous sores) চিকিৎসার ওপর তাঁর একটি মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেন যে, “একটি খুবই সত্য কথা (এবং যা আমাদেরকে বিনয়ী হতে সাহায্য করে) যে, সাধারণ, প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম যে-সব বস্তু ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়, তাদের অধিকাংশেরই গুণাগুণ জানা গেছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক ব্যবহার থেকে (অর্থাৎ দাদী-নানীদের কাছ থেকে)। আর এই কারণে বিজ্ঞ চিকিৎসকদের নিকট এসব গৃহ ব্যবহৃত ঔষধের গুরুত্ব অপরিসীম”।এই বইটি ছিল প্রধানত ট্রান্সসিলভানিয়ায় বসবাস কালীন সময়কার তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল। সেই সময়কার ডাক্তাররা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কোন গুরুত্ব দিতেন না। এই কারণে হ্যানিম্যান তাঁর এই পুস্তকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যায়াম, মুক্ত বায়ু সেবন, স’ান পরিবর্তন, ঠান্ডা পানির ঔষধি গুণ, সমূদ্র সৈকতে গমণ ইত্যাদির গুরুত্ব বুঝাতে অনেকগুলো পৃষ্টা ব্যয় করেন।তাঁর এই বইটি সমকালীন চিকিৎসক সমাজে বেশ সমাদর লাভ করে। লেখালেখি এবং অনুবাদে সাধারণত আয়-রোজগার খুবই কম হয়। এই কারণে ১৭৯০ সালের দিকে তিনি ভয়ানক দরিদ্রে পরিণত হন এবং দারিদ্র তাকে লিপজিগ ছেড়ে স্টোটারিজ শহরে গমণ করতে বাধ্য করে। এসময় ড্রিসডেন ইকোনোমিক্যাল সোসাইটি তাকে ফরাসী এবং ইংরেজী থেকে জার্মান ভাষায় বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিষয়ক পুস্তক অনুবাদে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য বিশেষভাবে সম্মাণনা প্রদান করে। ফলে চিকিৎসক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এবং (বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিষয়ক গ্রনে’র) অনুবাদক ও লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল।ফলে লিপজিগ থেকে তাঁর কাছে একটার পর একটা অনুবাদের অর্ডার মুষলধারে বৃষ্টির মতো আসতে লাগল। যদিও প্রাগ্য-বিদগ্ধ সমাজের পক্ষ থেকে প্রচুর স্বীকৃতি-সম্মানণা স’পাকারে তাঁর ওপর বর্ষিত হচ্ছিল, তথাপি এই প্রতিভাশালী এবং উচ্চাকাংখী ব্যক্তির আত্মাকে তা কি তৃপ্ত করতে পারছিল ? এই সমপর্কে হ্যানিম্যান নিজে লিখেছেন যে, “ড্রিসডেন শহরে অবস্থানকালীন সময়ে আমি উল্লেখযোগ্য কোন কাজ সম্পাদন করিনি”। অর্থাৎ তিনি বলতেচেয়েছেন যে, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ণে এসময় কোন অবদান রাখতে পারেননি ; কেননা তিনি কেবল প্রচলিত চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করেছেন এবং পরিবারের ভরণ-পোষণ করেছেন।কিংবদন্তীতুল্য প্রতিভাসমপন্ন এই লোকটি ছিল ভবঘুরে স্বভাবের। ১৭৯২ থেকে ১৮০৪ সাল পযর্ন্ত বার বছরে তিনি তাঁর গোটা পরিবার নিয়ে মোট চৌদ্দটি শহরে বসবাস করেছেন ; প্রতিটি শহরে গড়পড়তা কয়েক মাস করে। তাঁর এই ক্লানিতহীন পরিভ্রমণ কালে তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই নিঃসঙ্গ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি অতিশয় ত্যক্ত-বিরক্ত। এসময় তাঁর একমাত্র উপার্জন ছিল অনুবাদ কর্ম। তাঁর জীবনী লেখক হেল-এর মতে, অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রমই তাকে অসি’রভাবে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য করেছিল এবং যখনই চিনতার সাথে তাঁর বিরামহীন কুস্তি খেলার সমাপ্তি ঘটে, সাথে সাথে তাঁর বাসস্থান পরিবর্তনের অভ্যাসও বন্ধ হয়।তাঁর এই বিরামহীন ভ্রমণের শেষ পযার্য়ে তিনি টরগাউ (Torgau) শহরে আসন গাড়েন এবং এই শহরে সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছর অবস’ান করেন। তাঁর লেখালেখির সবচেয়ে বড় অংশটি এই শহরে রচিত হয়। ১৭৭৭ থেকে ১৮০৬ সালের মধ্যে তিনি মেগাসাইজের ২৪ টি পান্ডুলিপি এবং অগণিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুবাদ করেন। প্রতিটি অনুবাদেই তিনি নিজ থেকে অগণিত পাদটিকা সংযুক্ত করতেন এবং পুস্তকের ভুলক্রুটিও সংশোধন করে দিতেন। যতক্ষণ আঙ্গুল ব্যথা না হচ্ছে ততক্ষণ তিনি লেখার টেবিল থেকে ওঠতেন না। ডাক্তারী পেশার কথা তিনি এমনভাবে ভুলে গিয়েছিলেন, যেন মনে হতো তিনি কোনকালে ডাক্তারই ছিলেন না। বরং তিনি পাখির পালকের তৈরী কলমের একজন অন্ধ সাগরেদে পরিণত হয়েছিলেন।চিকিৎসকের পেশাকে মনে হতো তিনি কালির সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছেন।এই সময় তিনি তাঁর পড়াশুনা এবং গবেষণায় প্রাপ্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর নতুন আইডিয়া নিয়ে পত্রিকায় প্রবদ্ধ-নিবদ্ধ লিখতেন। অনেকগুলো বছরের ছন্নছাড়া জীবন এবং চিকিৎসা বিষয়ক বই-পুস্তক অনুবাদের ফলে হ্যানিম্যান চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর দিকগুলো সমপর্কে জানতে পারছিলেন এবং সেগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে -বাছাই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। হ্যানিম্যানের জীবনে এই সময়টি ছিল একটি চরম সন্ধিক্ষণ ; কেননা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর বৈপ্লবিক সব থিওরী এবং ফিলোসোফির প্রমাণ তাঁর হাতে আসার কারণে তাঁর ভেতরে আলোড়ণের সৃষ্টি হয় এবং ভেতরে ভেতরে তিনি নিজের ভবিষ্যত কর্মপদ্ধতি স্থির করে ফেলেন।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তিনি যেই বৈপ্লবিক আবিষ্কার সমপন্ন করেন তা প্রথম তাঁর মাথায় আসে ১৯৭০ সালে উইলিয়াম কালেন (William Cullen)-এর মেটেরিয়া মেডিকা অনুবাদ করার সময়। উক্ত পুস্তকে লেখা ছিল যে, কুইনাইন (Cinchona) মেলেরিয়া জ্বরের সুনির্দিষ্ট ঔষধ, কেননা এটি সুস্থ মানুষ খেলে তার শরীরের ম্যালেরিয়া জ্বর উৎপন্ন করতে পারে। বিষয়টি হ্যানিম্যানের বিশ্বাস হয় নাই ; ফলে তিনি সুস্থ শরীরে অল্লমাত্রায় কয়েকদিন সিনকোনা খেয়ে শরীরের তার ক্রিয়া পরীক্ষা করেন।বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেন যে, সত্যিসত্যি ম্যালেরিয়ার মতো কাঁপুনি দিয়ে শুরু হওয়া সবিরাম জ্বর তাঁর শরীরে সৃষ্টি হয়েছে। এই সময় তিনি যেই এলাকায় বসবাস করতেন, তা ছিল ম্যালেরিয়া উপদ্রুত অঞ্চল। ফলে তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যালেরিয়ামুক্ত এলাকায় গিয়ে পুণরায় সুস’ শরীরে সিনকোনা খেয়ে একই ফল পেলেন। ইহার পর তিনি আরো অনেকবার একই পরীক্ষা করে একই রেজাল্ট পান। তিনি তাঁর এই নতুন আবিষ্কারকে নাম দেন সদৃশ বিধান বা হোমিওপ্যাথি (homeopathy)। ল্যাটিন শব্দ homeo -এর অর্থ সদৃশ বা একই রকম এবং pathy অর্থ ভোগান্তি বা অসুখ। তিনি তাঁর এই বৈজ্ঞানিক সুত্রকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে যে, “সদৃশ সদৃশকে নিরাময় করে” (Like cures like)।ল্যাটিন ভাষায় বলা হয় similia similibus curentur. অর্থাৎ যে ঔষধ সুস’ শরীরে যে-রোগ সৃষ্টি করতে পারে, সেই ঔষধ অল্প মাত্রায় খাওয়ালে তা একই রোগ নিরাময় করতে পারে। আবার উল্টো করে বললে বলা যায় যে, যে ঔষধ যে রোগ সারাতে পারে, সেই ঔষধ সুস’ শরীরে খেলে একই রোগ তৈরীও করতে পারবে। হোমিওপ্যাথির বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে রোগী পর্যবেক্ষণের (observation of the sick) ওপর ভিত্তি করে।আমরা অনেকেই জানি না যে, এলোপ্যাথি(Allopathy)নামটিও হ্যানিম্যানের দেওয়া। ল্যাটিন শব্দ allos -এর অর্থ বিসদৃশ বা বিপরীত এবং pathy অর্থ ভোগান্তি বা অসুখ। যদিও এলোপ্যাথিক ডাক্তাররা এই নামটি পছন্দ করে নাই এবং গ্রহনও করেন নাই। তারা নিজেদেরকে আগেও সমকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞান (conventional medicine), অরথোডক্স মেডিসিন (orthodox medicine), স্কুল অব মেডিসিন (school ofmedicine) বা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান (modern medicine) ইত্যাদি ইত্যাদিবলত ; এখনও তাই বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এলোপ্যাথি নামটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং তারা এলোপ্যাথি নামেই তাদেরকে চিনে থাকে। সে যাক, হোমিওপ্যাথির শত্রুরা দুইশ বছর পুর্বেও হোমিওপ্যাথিকে বিজ্ঞান বলে স্বীকার করত না এবং এখনও করে না। কারণ নিম্নশক্তির হোমিও ঔষধে যদিও ঔষধ পাওয়া যায় কিন্তু ৩০ শক্তি বা তার চাইতে উচ্চ শক্তির হোমিও ঔষধে মুল ঔষধের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি এ যুগের সর্বাধুনিক কোন ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও তাতে মুলঔষধের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। তারপরও এসব ঔষধে কিভাবে কঠিন কঠিন সব রোগ সেরে যায়, প্রচলিত বিজ্ঞান তা ব্যাখ্যা করতে পারেন না। হয়ত ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের আরো উন্নতি হলে সেই রহস্য জানা যাবে।বতর্মানে জাপানী বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পানিরও স্মরণ শক্তি বিদ্যমান বর্তমানে ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি (classical homeopathy) নামে আমরা যে কথা শুনি, তার প্রচলন হয়েছে হ্যানিম্যানের মৃত্যুর একশ বছর পর থেকে। হ্যানিম্যান কিন্তু হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান নাই ; যতদিন বেঁচে ছিলেন ক্রমাগত গবেষণা করে তার মানোন্নয়ন করে গেছেন। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আজ পযর্ন্ত দুইশ বছর হলো হোমিওপ্যাথির ওপর সকল গবেষণা এবং উন্নয়ন বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও বিশেষজ্ঞদের মতে, হোমিওপ্যাথি এখনও প্রচলিত যে-কোন চিকিৎসা পদ্ধতির চাইতে অনেক অ-নে-ক উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি। এমনকি কেউ কেউ মনে করেন, হোমিওপ্যাথি দুইশ বছর পুর্বে আবিষ্কৃত না হয়ে যদি আরো দুইশ বছর পরে আবিষ্কার হতো তবে তা যুগের সাথে সবচেয়ে ভালো মানাসই হতো।হ্যানিম্যানের আরেকটি যুগানতকারী আবিষ্কার হলো সুস’ মানুষের শরীরে ঔষধের গুণাগুণ পরীক্ষা করা। কেননা প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইঁদুর-বিড়াল-বানর-গিনিপিগ-খরগোস ইত্যাদি বোবা জানোয়ারের ওপর ঔষধ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। বোবা জন’রা যেহেতু তাদের কষ্টের কথা বলতে পারে না, ফলে ঔষধ তাদের শরীর-মনে যে-সব রোগ সৃষ্টি করে, তার অনেকগুলোই জানা সম্ভব হয় না। কেননা এলোপ্যাথিক বিজ্ঞানিরা কেবল শরীরিক পরিবর্তন, পায়খানা, প্রস্রাব, রক্ত ইত্যাদির পরিবর্তনসমূহ পরীক্ষা করে ঔষধের একশান-রিয়েকশান জানার চেষ্টা করেন। এজন্য হ্যানিম্যান এবং তাঁর অনুসারী হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা, হোমিও চিকিৎসকরা এবং হোমিও কলেজের নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিটি হোমিও ঔষধ নিজেরা দীর্ঘদিন খেয়ে তাদের দেহ-মনে সে-সব ঔষধে গুণাগুণ পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।হ্যানিম্যান তাঁর জীবনকালে ৯০টি ঔষধ নিজের শরীরে পরীক্ষা করে তার বিসতারিত গুণাগুণ তাঁর রচিত “মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা” (Materia medica pura) নামক গ্রনে’ লিপিবদ্ধ করে গেছেন এবং বলতে হয় সিনকোনা ছিল তাঁর জীবনে তাঁর নিজের শরীরে পরীক্ষা করা ঔষধগুলোর মধ্যে প্রথম ঔষধ। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয় যে, ঔষধের মতো মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থকে নিজের শরীরে পরীক্ষা করার মধ্যে কতো অপরিসীম ত্যাগের মানসিকতা কাজ করে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেননা এসব ঔষধের মধ্যে আছে হৃদরোগ, যক্ষ্মা, ক্যানসারের ঔষধ যা দীর্ঘদিন খেয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে হার্ট এটাক, যক্ষ্মা, ক্যান্সার প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। এমন অকাল মৃত্যুর ঘটনা খোজঁলে অনেক পাওয়া যেতে পারে। হ্যানিম্যানের অনুসারী একজন ব্রিটিশ হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন ডাঃ জে. সি. বার্নেট।এই বার্নেট ক্যান্সারের অনেকগুলো হোমিও ঔষধ আবিষ্কার করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন সেগুলো খেয়ে নিজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। হ্যানিম্যান এবং তাঁর অনুসারী অধিকাংশ হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানী যেখানে গড়ে ৮০ বছরের বেশী আযু পেয়েছেন, সেখানে বার্নেট মৃত্যুবরণ করেন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে। আজ সবাই একমত যে, ক্যান্সারের অনেকগুলো ঔষধ নিজের শরীরে পরীক্ষা করাই ছিল তাঁর অকালমৃত্যুর মুল কারণ। মানবজাতিকে রোগ-ব্যাধির কড়ালগ্রাস থেকে মুক্ত করতে হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যেভাবে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, এই রকম ত্যাগের ঘটনা সত্যি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।দিনের পর দিন হ্যানিম্যান নিজের শরীরে একের পর এক ঔষধ পরীক্ষা করে গেছেন। সাথে সাথে পরিবারের সদস্য এবং চিকিৎসক বন্ধুদের ওপরও ঔষধ পরীক্ষা করেছেন যারা মানব কল্যাণে যে-কোন ত্যাগ স্বীকারে ছিল সদা প্রস’ত। পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধু-বান্ধবরাই তাঁর গবেষণায় মুল ভূমিকা পালন করত। হ্যানিম্যান তাঁর সনতানদের মাঠে পাঠিয়ে দিতেন ঔষধি গাছপালার পাতা, ফুল এবং শিকড় সংগ্রহ করে আনার জন্য ; যেগুলো তৎকালে এলোপ্যাথিক এবং কবিরাজি চিকিৎসাতে ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং যেগুলো ব্যবহৃত হতো না, তাদের সবই। এভাবে তিনি তাঁর গবেষণার কাজে অনেক মানুষকে জড়িত করতেন; কেননা তিনি যে টাইটানিক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহন ছাড়া তাহা বাসতবায়ন করা সম্ভব ছিল না।অবসর সময়ে তিনি ঔষধের ক্রিয়ার ফলে প্রত্যেকের শরীরে ও মনে কি কি পরিবর্তন সুচিত হয়েছে বা রোগ লক্ষণের সৃষ্টি হয়েছে, তা শুনে (মাথা, মন, নাক, কান, পাকস’লী, হৃৎপিন্ড, যৌনাঙ্গ প্রভৃতি শিরোনাম অনুযায়ী) শ্রেণীবিন্যাস করে বিসতারিতভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। নিজের ও আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের শরীরে ঔষধ পরীক্ষার পাশাপাশি ঔষধের বিষক্রিয়ার (poisoning) রেকর্ডও তিনি সংগ্রহ করতেন। অর্থাৎ কোন একটি ঔষধ ভুলবশত অথবা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কেউ প্রচুর পরিমাণে খাওয়ার ফলে তার শরীরে যে-সব লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, সে-সব লক্ষণ তিনি সংগ্রহ করে সবিসতারে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন।কেননা এসব লক্ষণ স্বাভাবিকভাবে যদি কারো শরীরে দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে ঐ ঔষধটি অল্পমাত্রায় শক্তিকৃত করে খেলে সেই সে-সব রোগ লক্ষণ চলে যাবে।ঔষধ নিয়ে এই ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঔষধের সত্যিকার ক্রিয়া ক্ষমতা সমপর্কে নিশ্চিত তথ্য সংগ্রহ করা;কেননা তখনকার দিনে (এমনকি এখনও) প্রচলিত (এলোপ্যাথিক/ কবিরাজি প্রভৃতি) ঔষধের গুণাগুণ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যই ছিল ব্যক্তিগত (অপ্রমাণিত) মতামত এবং (ঔষধটি সমপর্কে) ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংগৃহীত। এভাবে আরো পনের বছর চলে গেছে তিনি তাঁর চিনতা-ভাবনা, অভিজ্ঞতা এবং আবিষ্কারকে গুছিয়ে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার পুর্বেই।১৭৯৬ সালে তাঁর রচিত Essay on a New Principle প্রবন্ধে তাঁর নতুন আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মুল বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছিল। এসময় তিনি পুণরায় চিকিৎসা পেশা গ্রহন করেন। তবে তিনি রোগীদেরকে দিতেন তাঁর আবিষ্কৃত নতুন ধরণের (হোমিও) ঔষধ যার জন্য তিনি রোগীদের নিকট থেকে ফি রাখতেন না। এসময় তাঁর চিকিৎসানীতি ছিল প্রতি রোগীর জন্য একবারে একটি মাত্র ঔষধ এবং অবশ্যই তা সুস’ মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা ঔষধ। এখানে উল্লেখ করা কর্তব্য যে, তৎকালে (এমনকি এখনও) এলোপ্যাথিক চিকিৎসকরা একটি একসাথে পনের থেকে বিশটি পযর্ন্ত ঔষধ দিতো যার ফলে দেখা যায় একটি রোগ চাপা পড়ে (ঔষধের প্রতিক্রিয়ায়) আরো একাধিক মারাত্মক রোগের জন্ম হতো।এসময় ল্যাটিন ভাষায় তাঁর Fragmenta dee viribus medicamentorum positivis নামক গ্রন্থটি প্রকাশ হয়, যাতে Pulsatilla, Ignatia, Aconite, Drosera, Belladonna ইত্যাদিসহ ২৭টি ঔষধের পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ (proving) বিসতারিত বিবরণ ছিল। এই বইটি এবং তাতে উল্লেখিত ঔষধ পরীক্ষার নতুন পদ্ধতিটি ছিল চিকিৎসক সমাজের নিকট একেবারেই আনকোরা, বিস্ময়কর, অভিনব। তিনি এমন একটি চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে চেষ্টা করছিলেন যাতে রোগীদেরকে একবারে মাত্র একটি ঔষধ দেওয়া হবে, ক্ষতি করতে না পারে এমন অল্পমাত্রায় ঔষধ দেওয়া হবে এবং আন্দাজ-অনুমাণ নয় বরং সুস’ মানুষের শরীরে পরীক্ষা করে ঔষধের গুণাগুণ সমপর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে এমন ঔষধ রোগীদের দেওয়া হবে। তিনি ছিলেন মিকচার ঔষধের জানি দুষমণ অর্থাৎ রোগীদেরকে এক সাথে গন্ডায় গন্ডায় ঔষধ দেওয়া সমর্থন করতে না।কেননা এতে এক ঔষধের সাথে অন্য ঔষধের রিয়েকশনের ফলে রোগীদের কি কি ক্ষতি হতে পারে, তা জানার কোন উপায় ছিল না। তিনি মনে করতেন ডাক্তারদের তাদের নিজের ঔষধ নিজেই তৈরী করে নেওয়া উচিত; কেননা এভাবেই ঔষধের বিশুদ্ধতা সমপর্কে ডাক্তার সাহেব নিশ্চিত হতে পারেন। অনেকে মনে করেন, হ্যানিম্যান ঔষধ কোমপানীর ঘোর বিরোধী ছিলেন। কেননা (এলোপ্যাথিতে যেমনটা দেখা যায়) ঔষধ কোমপানীগুলো ঔষধ আবিষ্কার, ঔষধ তৈরী এবং ঔষধ ব্যবসায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব লাভ করলে চিকিৎসকরা তাদের কাছে অসহায় (পুতুল) হয়ে পড়েন।১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর The Medicine of Experience নামক বইটি যা ছিল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মুলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ অর্গানণের (Organon of Medicine) পুর্বসুরী। ১৮০৫, ১৮০৮ এবং ১৮০৯ সালে প্রকাশিত অন্যান্য প্রবন্ধমালার আলোচ্য বিষয় ছিল প্রচলিত সকল চিকিৎসা পদ্ধতিসমূহের যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা এবং সদৃশ বিধান (similia) এবং এক রোগী এক ঔষধ (single drug) নীতি কেন সর্বকালের শ্রেষ্ট তার ব্যাখা সম্বলিত। ইহার পরপরই ১৮১০ সালে প্রকাশিত তাঁর কিংবদনতীতুল্য গ্রন্থ অর্গানন অব দ্যা আর্ট অব হিলিং আর্ট (Organon of the Art of Healing) যাতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মুলনীতিগুলোকে আইনের ধারার মতো একে একে সজ্জিত করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ইহা ছিল একটি সমপূর্ণ নতুন এবং অন্যগুলোর চাইতে আলাদা চিকিৎসা বিজ্ঞান হিসেবে হোমিওপ্যাথির যাত্রাপথের একটি মাইলফলক (landmarks) স্বরূপ।অর্গাননের প্রতিটি সুত্রকে লেখা হয়েছে আইনের ধারার মতো সংক্ষিপ্ত আকারে, কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে, কঠিন কঠিন ভাবের সমন্বয়ে যাদেরকে পাশাপাশি পাদটিকা দিয়ে ব্যাখ্যা করা না হলে বুঝা মুশকিল হতো। বাঁধ-ভাঙা স্রোতস্বিনীর মতো এরকম একটি মৌলিক কৃতিত্বের পেছনে ছিল তাঁর দুই যুগের অধ্যয়ন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গভীর চিনতা-গবেষণা।
১৮০৬ সালে তিনি তাঁর সর্বশেষ অনুবাদ করেন Albrecht von Haller -এর মেটেরিয়া মেডিকা লেটিন ভাষা থেকে জার্মান ভাষায়। ইহার পর তিনি নিজের গবেষণা কর্মকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জীবনের এই সুদীর্ঘ সময় জুড়ে অধ্যয়ন এবং অনুবাদের মাধ্যমে কেবলমই অন্যদের কর্মের সাথেই পরিচিত হয়েছেন।
এখন থেকে আর অন্যদের কাজ নয় ; কেবল নিজের (চিনতা-গবেষণা-আবিষ্কারকে বাসতবে রূপ দেওয়ার) কাজ নিয়ে ব্যসত থাকা।আজ থেকে দুইশ বছর পুর্বের একটি অগ্রসর সমাজ এবং সময়ে দারুণ বৈপ্লবিক কিছু আবিষ্কার করলেই আবিষ্কারকে দ্বায়িত্ব শেষ হয়ে যেতো। মানবতার কল্যাণের জন্য সেই আবিষ্কারকে প্রচার-প্রসার করা এবং শত্রুদের জিংঘাসা থেকে তাকে রক্ষা করার কঠিন দ্বায়িত্বও আবিষ্কারককেই পালন করতে হতো। মানবজাতিকে কুচিকিৎসার হাত থেকে রক্ষার জন্য সারা বিশ্বে হোমিওপ্যাথিকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং রক্ষা করার জন্য হ্যানিম্যানকে আমৃত্যু কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে।তাছাড়া হোমিওপ্যাথির জন্মটা ছিল একটি দীর্ঘ জনম ; ১৭৯০ সাল থেকে ১৮৫৫ সালে হ্যানিম্যানের মৃত্যু পযর্ন্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবির্ভাব হয়েছে টুকরা টুকরা, অংশ খন্ডাংশ রূপে। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হোমিওপ্যাথির মুল সুত্রগুলি (aphorism) আবিষ্কার করেছেন, আরো গবেষণা-পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পর্যায়ক্রয়ে তাদেরকে সংশোধন-পরিবধন-পরিবর্তন করেছেন, ঔষধ আবিষ্কার করেছেন, ঔষধের মাত্রাতত্ত্ব (posology) আবিষ্কার করেছেন, ঔষধের শক্তিবৃদ্ধি (potentization) করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন, জটিল (chronic) রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, রোগীদের শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি (miasm theory) আবিষ্কার করেছেন।
তাঁর সমস্ত আবিষ্কারকে তিনটি মৌলিক পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বিভিন্ন সংশোধনীর পর অনেকগুলি এডিশন বের করেছেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকরূপে বিবেচ্য এই বইগুলো হলো- অর্গানন অব মেডিসিন (Organon of Medicine), মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা (Materia Medica Pura) এবং ক্রনিক ডিজিজ (Chronic disease)। তাছাড়া লেসার রাইটিংস (Lesser writings) নামে তাঁর আরেকটি মৌলিক গ্রন্থ বিদ্যমান আছে যাতে তাঁর ছোট ছোট সমসত গবেষণা প্রবদ্ধগুলি সংকলিত হয়েছে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, টরগাউ অবস’ান কালে সিস্টেমেটিক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একবারে একটি ঔষধ প্রয়োগের বিধান (single drugs) এবং সদৃশ বিধানের মাধ্যমে ঔষধ নির্বাচনের পদ্ধতি (similia) ছাড়া তৎকালে প্রচলিত এবং মধ্যযুগের সমসত চিকিৎসা পদ্ধতিকে অগ্রহযোগ্য-বাতিল ঘোষণা করেন।
১৮১২ সালে হ্যানিম্যান পুণরায় লিপজিগ শহরে ফিরে যান ; মুল উদ্দেশ্য ছিল এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করা। তিনি ফিরে এসেছিলেন শিক্ষক হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়ার জন্য তাঁর আবিষ্কৃত নতুন চিকিৎসা বিজ্ঞান সমপর্কে।হেলিবোরের (Hellebore) ওপর একটি অভিসন্দর্ভ (thesis) জমা দিয়ে তিনি ইউনিভার্সিটিতে মেডিক্যাল ফেকাল্টির একটি অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। তাঁর এই থিসিসে প্রাচীনকাল থেকে সমকালীন অনতত পঞ্চাশজন ডাক্তার, দার্শনিক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন ইউরোপে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষায়। সমকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞান আর ভাষার ওপর হ্যানিম্যানের জ্ঞান ছিল এতই গভীর আর বিস্তৃত।
জার্মান,ফ্রেন্স,ইংরেজী,ইটালীয়ান,ল্যাটিন,গ্রিক, হিব্রু এবং এরাবিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভাষার ওপর তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলকে বিমুগ্ধ করেছিল। তারপরও ক্লাশে ছাত্রদের প্রতি তাঁর লেকচার শুরু হতো ভালোভাবেই কিন্তু শেষ হতো ব্যাঙ্গাত্মক সুরে। কেননা তার বেশীর ভাগ জুড়ে থাকতো সমকালীন এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আক্রমণ, তিক্ত সমালোচনা যা টর্নেডোর গতিতে প্রবাহিত হতে থাকতো। এসব দেখে-শুনে তাঁর ছাত্ররা সঙ্কুচিত-জড়সড় হয়ে পড়তো। সমকালীন চিকিৎসা পদ্ধতির বলগাহীন, তিক্ত-কটু সমালোচনার কারণে তাঁর ক্লাশে ছাত্রদের সংখ্যা কমতে লাগলো এবং ১৮২০-১৮২১ সালের শীতকালীন সেমিষ্টারে ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র সাত জন। এই পরিসি’তিতে অনিবার্যভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।অন্যদিকে তাঁর প্রশিক্ষণ কোর্সটি যদি ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করত এবং তাঁর ফ্যাকাল্টিতে ছাত্রদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেত, তবে অন্যান্য এলোপ্যাথি পন’ী অধ্যাপকদের পক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগা এতো সহজ হতো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাসতবে তেমনটি হয়নি। তাঁর ওপর এবং হোমিওপ্যাথির ওপর এলোপ্যাথি পন’ীদের বেদনাদায়ক আক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, অনেকটা নির্মুল অভিযানের মতো। বিরুদ্ধবাদীদের উৎপীড়ন এতই বৃদ্ধি পায় যে, লিপজিগ শহরে তাঁর জীবন ধারণই অসম্ভব হয়ে পড়ে।ছাত্রদের অবহেলা এবং এড়িয়ে চলার কারণে তিনি লিপজিগ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আরেকটি বড় কারণ ছিল এলোপ্যাথিক ডাক্তারদের প্ররোচনায় একটি সরকারী আইন পাশ হয় যে, নিজে নিজে ঔষধ প্রস’ত করে রোগীদের মধ্যে বিতরণ করা যাবে না। যেহেতু হোমিওপ্যাথি ছিল তখন একটি নতুন আবিষ্কৃত চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং হোমিও ঔষধ প্রস’তকারী কোন ঔষধ কোমপানী তখনও প্রতিষ্টিত হয়নি, ফলে লিপজিগে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতে হ্যানিম্যান আইনগত বাঁধার সম্মুখীন হন। হ্যানিম্যান সেখানে নিজেকে অপাঙতেয় ভাবতে থাকেন এবং দেশ ত্যাগ করাকেই ইহার একমাত্র সম্মানজনক সমাধান হিসেবে সিদ্ধানত গ্রহন করেন।কোহেনের অনতর্গত আলটোনার মহান ডিউক ফারডিন্যাণ্ডে সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির মাধ্যমে তাঁর লিপজিগ ত্যাগ করার পথ প্রশসত হয়। কোহেনের উিউক তাকে একটি সরকারী চিকিৎসকের পদ এবং স্বাধীনভাবে গবেষণা আর নিজের আবিষ্কৃত নতুন ধরণের (হোমিওপ্যাথিক) ঔষধ তৈরী করা ও রোগীদের প্রদানের আইনগত অধিকার প্রদান করেন ফলে ১৮২১ সালের জুন মাসে তিনি লিপজিগ ত্যাগ করে কোহেন গমন করেন। কোহেনে তিনি সব ধরণের সুযোগ-সুবিধাই পেয়েছেন ; ফলে এটি তাঁর নিকট আল্লাহর বিশেষ রহমতের মতোই মনে হচ্ছিল। এখানে তিনি সত্রী ও দুই কন্যা (চার্লোট ও লুইসা)-কে নিয়ে “স্বর্গীয় নিঃসঙ্গতায়” কাটিয়েছেন চৌদ্দটি বছর। এই সময়গুলোতে তিনি তাঁর গবেষণা প্রবদ্ধগুলি এবং (অর্গানন, মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা ইত্যাদি) বই-পুস্তকগুলো ক্রমাগত ছাপিয়েছেন এবং বিভিন্ন সংশোধন-সংষ্কারের মাধ্যমে নতুন নতুন এডিশন বের করেছেন।১৮২৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর যুগানতকারী গ্রন্থ ক্রনিক ডিজিজ (The Chronic Diseases) যাতে জটিল রোগের (Chronic Diseases) অনতর্নিহিত কারণগুলোকে (dyscrasia, susceptibility) তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় ঃসোরা (Psora- skin diseases with itching), সাইকোসিস (Sycosis gonorrhoea- diseases with growth) এবং সিফিলিস (Syphilis- diseases with decay)। এগুলোকে তিনি নামকরণ করেন শারীরিক-মানসিক গঠনগত ক্রটি বা মায়াজম (miasm) নামে। অন্যভাবে বললে মায়াজমকে বলা যায় রোগ প্রবণতা (disposition or disease tendency) অর্থাৎ ব্যক্তি ভেদে বিশেষ ধরণের রোগ বেশী বেশী হওয়ার প্রবণতা। অগণিত দীর্ঘ গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণে তিনি আবিষ্কার করেন যে, অধিকাংশ পুরাতন জটিল রোগের সাথে পুর্বকালে ছড়িয়ে পড়া সোরার সমপর্ক আছে। হ্যানিম্যানের মতে, সোরা হলো ক্রনিক রোগের মুল কারণ যা হাজার হাজার বছর ধরে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বংশগতভাবে চলে আসে।এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত যে, এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অসারতা এবং বর্বরতার কারণে হতাশ হয়ে হ্যানিম্যান এলোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে বর্জন করেছিলেন এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিকেও বর্জন করার সিদ্ধানত নিয়েছিলেন। কেননা এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় সে যুগে অধিকাংশ রোগই সারানো যেতো না এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার কারণে রোগী তার চাইতে আরো বেশী মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতো। পক্ষানতরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অধিকাংশ রোগই খুব সহজে নিরাময় করা যেতো কিন্তু হ্যানিম্যান লক্ষ্য করে দেখলেন যে, যে-রোগ তিনি সারিয়ে দিলেন, দু’চার বছর পর একই রোগে আক্রান্ত হয়ে সেই রোগী আবার তাঁর নিকট ফেরত আসছে।তিনি দেখলেন যে-রোগীর ফোড়াঁ, পাইলস, হাঁপানি ইত্যাদি জটিল রোগ তিনি সারিয়ে দিচ্ছেন, সেই রোগী দু’চার বছর পরপর একই রোগে আক্রান্ত পুণরায় হয়ে তাঁর নিকট ফেরত আসছে। তখন তিনি পারলেন যে, রোগের মুল কারণটি দুর না হওয়ার কারণেই জটিল রোগ পুরোপুরি নির্মুল হচ্ছে নাএবং রোগীরা একই রোগে কিছুদিন পরপর আক্রান্ত হচ্ছে। ইহার পর তিনি মুল কারণসমূহ আবিষ্কার করার জন্য দীর্ঘ বারো বৎসর গবেষণা করে এই মায়াজম থিওরী আবিষ্কার করেন। আজ থেকে দুইশ বছর পুর্বে বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনগ্রসরতার যুগে তাঁর এই মায়াজম থিওরীকে (Miasm theory) এতই জটিল এবং রহস্যময় মনে হতো যে, প্রথম দিকে তাঁর অধিকাংশ অনুসারী এটিকে গ্রহন করতে অস্বীকার করেন (এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও অনেকদিন পযর্ন্ত) এবং এ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকেন।কিন্তু তারপর আসেত আসেত সবার নিকটই তাঁর মায়াজম থিওরী বাসতব সমমত এবং সত্য বিবেচিত হতে থাকে এবং গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাঃ বার্নেট লিখেছেন যে, “হ্যানিম্যানের সোরা (Psora) ভালোভাবে পড়ে আমি এতটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারি নাই। তবে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি যা লিখেছেন তা সত্য”। একইভাবে তিনি ৩০ (ত্রিশ) শক্তির ঔষধকে আদর্শ শক্তি (standard potency) হিসেবে প্রতিষ্টা করার চেষ্টা করেন কিন্তু তাঁর অনুসারীরা এটিকে গ্রহন করেনি। তাঁর অর্ধেক অনুসারী ১, ৩, ৬ ইত্যাদি নিন্মশক্তির ভক্ত হয়ে যায় এবং বাকী অর্ধেক অনুসারী দশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার, এক লক্ষ ইত্যাদি উচ্চ শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে (যা ছিল হ্যানিম্যানের সময়ে অকল্পনীয়)।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর চার বছর ছয় মাস পর ১৮৩৫ সালের ১৮ই জানুয়ারী হ্যানিম্যান দ্বিতীয় বিয়ে করেন মেলানি’কে (Melanie D’Hervilly Gohier)।সে ছিল ফ্রান্সের এক সুন্দরী, আকর্ষণীয়া তরুণী আর্টিস্ট। মেলানী প্রথমে ছিলেন হ্যানিম্যানের রোগী, তারপরে ছিলেন হোমিওপ্যাথির ছাত্রী এবং শেষে ছিলেন প্রেমিকা এবং স্ত্রী।মেলানী বয়সে ছিলেন হ্যানিম্যানের চাইতে চল্লিশ বছরের ছোট।মেলানী ১৮৩৪ সালের ৮ই অক্টোরব প্রথম যখন চিকিৎসার জন্য ফ্রান্স থেকে জার্মানীর কোহেন নগরে হ্যানিম্যানের চেম্বারে এসে উপসি’ত হন, তখন তিনি যারপর নাই বিস্মিত হয়েছিলেন এই তরুণীর কর্মকাণ্ড দেখে। জার্মানীর কোহেন নগরীতেই তাদের বিয়ে হয় এবং জানুয়ারীতে বিয়ের পর জুন মাসের ৭ তারিখে তিনি দেশত্যাগ করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। মানবজাতিকে রোগমুক্ত করার মানসে তাঁর এই হিজরত ছিল অনেকটা আরব্য রজনীর রূপকথার মতো।তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, ব্যতিক্রমধর্মী অসাধারণ প্রতিভাসমপন্ন ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সবচেয়ে বেশী স্বাধীনতা দেওয়া হয়ে থাকে প্যারিসে। তাদের এই অদ্ভুত এবং বিম্মিয়কর প্রেম এবং বিয়ের ঘটনা জার্মানীর পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় অভদ্র প্রতিবেশী এবং বৈরী ভাবাপন্ন চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি বৃষ্টির মতো অপমানজনক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নাজিল হতে লাগলো। হ্যানিম্যানের প্যারিস গমণের পর তাঁর কন্যারা এসে পিত্রালয়ে বসবাস করা শুরু করে এবং মৃত্যু পযর্ন্ত তারা সেখানেই বসবাস করেছে। তারা তাদের সৎমা মেলানীকে তেমন পছন্দ করতো না। মেলানীর কর্মকাণ্ড বা উদ্দেশ্য সমপর্কে আমরা যাহাই বলি না কেন, হ্যানিম্যান তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের নিকট অনেক চিঠিতেই লিখেছিলেন যে, মেলানীর ভালবাসা এবং সেবা-যত্নে তিনি বর্তমানে খুবই সুখী জীবন-যাপন করছেন।প্যারিসে হ্যানিম্যানের জীবনের এই শেষ আট বছরে তিনি ছিলেন একজন বিশ্বখ্যাত মহাব্যসত ডাক্তার এবং তাঁর তরুণী সত্রী ছিল তাঁর সহকারী চিকিৎসক।এসময় ধনী, বিত্তশালী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সবচেয়ে পছন্দের ডাক্তার ছিলেন হ্যানিম্যান। বর্ণনামতে, এই আট বছরে হ্যানিম্যান ও মেলানী দুইজনে মিলে আয় করেছিলেন আট লক্ষ ফ্রাঙ্ক। পাশাপাশি দরিদ্র রোগীদের তিনি চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায় ; তাদের নিকট থেকে ফি এবং ঔষধের মুল্য কোনটাই রাখতেন না। মেলানী তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য চিরকালই একজন রহস্যময় নারী হিসেবেই থেকে যাবেন।
তাঁর শত্রুদের মতে, “মেলানী একজন উচ্চাভিলাসী, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী এবং ধান্ধাবাজ বুদ্ধিজীবি মহিলা ছিলেন বিশেষতঃ সেই ভদ্র, দুরদৃষ্টিসমপন্ন এবং রোমান্টিক পুরুষটির (হ্যানিম্যান) জন্য যে তাকে ভালবাসত”। মেলানী কখনও হ্যানিম্যানের পাশ ছাড়তেন না।তিনি হ্যানিম্যানের রোগীলিপিগুলি (casebooks) মুখসত করেছিলেন। মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা’র (Materia Medica Pura) অনেক জটিল লক্ষণ এবং দুর্লভ নোট ছিল তাঁর নখদর্পণে যা হ্যানিম্যানের অন্যকোন ছাত্রের পক্ষে ছিল না। ফলে তিনি হোমিওপ্যাথির একজন জীবনত বিশ্বকোষে (encyclopaedia) পরিণত হন। মেলানী সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত হন দুটি কাজের মাধ্যমে ; একটি হলো হ্যানিম্যানের মৃত্যুর পর কাউকে না জানিয়ে তাড়াতাড়ি অতি গোপনীয়তার সাথে হ্যানিম্যানকে দাফন করা এবং দ্বিতীয়ত হ্যানিম্যান রচিত অর্গাননের ষষ্ট সংষ্করণ প্রকাশ না করে প্রায় সত্তর বছর লুকিয়ে রাখা।গবেষকদের মতে, মৃত্যুর পুর্বে হ্যানিম্যান ইসলাম গ্রহন করে মুসলিম হয়েছিলেন ; হয়ত হ্যানিম্যানের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে খ্রিষ্টান ধর্ম মতে দাফন না করার জন্যই মেলানী তড়িগড়ি করে গোপনে (মুসলিম কায়দায়) সমাহিত করে থাকতে পারেন। কিন্তু অর্গাননের ষষ্ট সংষ্করণ প্রকাশ না করে কেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার কারণ আজও অজানা। (উল্লেখ্য, হ্যানিম্যান অর্গাননের ষষ্ট সংস্করণ সমপূর্ণ রচনা করা সত্ত্বেও হঠাৎ মৃত্যুবরণ করায় নিজে তা প্রকাশ করে যেতে পারেন নাই।)হ্যানিম্যান যদিও নিঃশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে (অর্থাৎ ঔষধের গন্ধ শুঁকার মাধ্যমে) রোগীদের শরীরে ঔষধ প্রয়োগের পদ্ধতি (Olfaction) চালু করেছিলেন, কিন্তু তা ছিল তাঁর দীর্ঘ জীবনের শেষের দিকের (প্যারিসে অবস’ানকালীন সময়ের) আবিষ্কার। তাছাড়া ঔষধের পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিকরণ পদ্ধতিও (LM potency) তাঁর শেষ জীবনের আবিষ্কার যা অর্গাননের ষষ্ট সংষ্করণে তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ১৮৪২ সালে প্যারিসে তিনি অর্গাননের পঞ্চম সংষ্করণের সর্বশেষ পুণঃলিখন সমপন্ন করেন যদিও তা কখনও প্রকাশকের নিকট পাঠানো হয়নি। এটা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, প্যারিসে অবস’ানকালীন হ্যানিম্যানের জীবনের শেষ আটটি বছর ঔষধের মাত্রা, শক্তি ও ঔষধের প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কেটেছে।
এই সময়ে তিনি ঔষধের তরল মাত্রা এবং পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা হোমিও চিকিৎসকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেনি।শেষ বয়সে হ্যানিম্যানের শরীর পাতলা (চিকন) এবং বেটে-খাটো হয়ে গিয়েছিল। হাঁটু সামান্য বেঁকে গিয়েছিল এবং তাঁর শরীরের মধ্যাংশও কিছুটা সামনের দিকে বেঁকে গিয়েছিল যার ফলে পুরোপুরি খাড়া-সোজা হয়ে দাঁড়াতে তাঁর কোন অসুবিধা হতো না। ১৮৪৩ সালের ২রা জুলাই প্যারিসে হ্যানিম্যান ইনেতকাল করেন ব্রঙ্কাইটিস রোগে (ইন্নালিল্লাহে……রাজেউন) এবং মন্টমার্ট্রিতে (Montmartre) তাকে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকান হোমিও ডাক্তাররা অর্থ ব্যয় করে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আরেকটি অভিজাত গোরস’ানে (Cimitiêre Pere Lachaise) পুণরায় দাফন করেন, যেখানে অনেক বিখ্যাত লোকদের কবর ছিল।
ইউরোপ, রাশিয়া, ইন্ডিয়া এবং আমেরিকাতে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়েছিল প্রধানত (অর্ধেকটা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচারের জন্য এবং বাকীটা হোমিও চিকিৎসার যাদুকরী রোগ নিরাময় ক্ষমতার কারণে)। হোমিওপ্যাথির প্রচার-প্রসারে প্রতিটি দেশেরই ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত অসুস্থ মানুষের মর্মান্তিক বেদনাকে যিনি নিজের হৃদয় দিয়ে সবচেয়ে বেশী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাঁর নাম স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। প্রচলিত চিকিৎসা বিজ্ঞানসমূহের ইতিহাস নিয়ে যারা ব্যাপক পড়াশুনা করেছেন, তারা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, তিনি ছিঁলেন পৃথিবীতে আজ পযর্ন্ত জন্ম নেওয়া সর্বশ্রেষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী।
ডা. ইয়াকুব আলী সরকার
ইভা হোমিও হল
বাইপাইল আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা।
গোভা:রেজিস্ট্রেশন নং২৩৮৭৬
মোবাইল নাম্বার ০১৭১৬৬৫১৪৮৮,০১৬৩৭৬৮৮৯৪১।
তিনি শেষ জীবণে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ফ্রান্সে হিজরত করেন।
উত্তরমুছুন