শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭

রমনীদের ঋতু চক্রের আদ্যোপান্ত।

ঋতুচক্রের ক্যালেন্ডার।

নারীদের ঋতুচক্র--
----------------------- 
গ্রিক শব্দ "মেন" অর্থ মাস। এই মেন শব্দ থেকেই মেনস্ট্রুয়েশন কথাটি এসেছে। মেনস্ট্রুয়েশন কেই ঋতু বলা হয়। এই ঋতু দর্শনেই একটি নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতার প্রকাশ পায়।ঋতুস্রাব হলো প্রতিমাসে যোনি দ্বারা নির্গত রক্তস্রাব যা চার থেকে পাঁচ দিন ধরে নির্গত হয় এবং প্রতি ২৮ দিন(২৮ দিনের আগে বা পরে ৪ দিনের মধ্যে হতে পারে) অন্তর প্রতিটি প্রজননক্ষম নারীর মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। মাসিক এই ঋতুস্রাব এর মধ্যে দিয়েই ঋতুচক্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া টি বজায় থাকে।

হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি এবং ওভারির মিলিত কার্যের ফলে এন্ডোমেট্রিয়ামের যে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তনের ফলেই মাসানুমাসিক ঋতুস্রাব এবং মাসিক ঋতুচক্রের স্বাভাবিক চক্রটি বজায় থাকে।

এন্ডোমেট্রিয়ামের স্তর ক্ষয় থেকেই এই ঋতুস্রাব হয়। যদিও এই রক্তস্রাব সম্পুর্ণ স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। আর এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হরমোনের কার্যের উপর নির্ভরশীল।

মোটামুটি ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই প্রথম ঋতুস্রাব দেখা যায়। মোটামুটি ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়। মাঝের এই সময় কালে ২৮ দিন(আগে-পরে চারদিনের মধ্যে) অন্তর ৪ থেকে ৫ দিন ধরে ২০ থেকে ৮০ মিলিলিটার রক্তস্রাব মহিলাদের যোনিপথ থেকে নির্গত হয়। এই রক্তস্রাব ঈষৎ পরিবর্তিত রক্ত, মিউকাস, এন্ডোমেট্রিয়ামের অংশ, যোনীদেশের আবরণী কলার অংশ, বিভিন্ন উৎসেচক, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গঠিত হয়। ঋতুস্রাবের বর্ণ ঈষৎ কালচে লাল হয়, এবং ঋতুস্রাবে একটি বিশেষ আঁশটে গন্ধ থাকে।




এবার বলি এন্ডোমেট্রিয়াম কি এবং তার বিভিন্ন পরিবর্তন---

----------------------------------------------------------
জরায়ুর অভ্যন্তর মুখ (internal OS) এর উপরের যে বিশেষ আবরণী কলার স্তর থাকে তাকে বলে এন্ডোমেট্রিয়াম। জরায়ুর অভ্যন্তর মুখের উপরের অংশ পুরো জরায়ুর অভ্যন্তর ভাগে এই বিশেষ কলা স্তর আবৃত করে রাখে।

এন্ডোমেট্রিয়াম কে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায় একটি অংশ হলো ব্যাসাল জোন এবং আরেকটি অংশ হলো সুপারফিসিয়াল বা ফাংশানাল জোন। ব্যাসাল জোন অংশটি মায়মেট্রিয়াম সংলগ্ন থাকে। এন্ডোমেট্রিয়াম এর এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলজুড়ে ব্যাসাল জোন গঠিত হয়। ব্যসাল জোনে অনেক রক্তবাহী নালী থাকে। বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ এর জন্য এই স্তরের পরিবর্তন হয় না। ব্যাসল স্তরে কোন পরিবর্তন না হলেও এর উপরের স্তর অর্থাৎ সুপারফিসিয়াল বা ফাংশনাল জোনে ঋতুচক্রের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়। বিশেষত ঋতুস্রাবের সময় ওই সুপারফিসিয়াল স্তরটি ক্রমশ ঝরে যেতে থাকে। কিন্তু ঋতুস্রাবের পর এই অংশটি আবার মেরামত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। একে বলে রিজেনারেশন।
ঋতুচক্রের বিভিন্ন সময়ে এই স্তরে বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন হয়। ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে এই স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়। এই পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়--
১. রিজেনারেটিভ ফেজ--
------------------------------
ঋতুস্রাব বন্ধ হবার কিছু আগে থেকেই এই ফেজ শুরু হয়। একে এন্ডমেট্রিয়াম এর মেরামতের সময় বলা যেতে পারে। ঋতুস্রাব বন্ধ হবার ২ থেকে ৩ দিন পর্যন্ত এই রিজেনারেশন প্রক্রিয়া চলতে থাকে।আগেই বলেছি এই এন্ডোমেট্রিয়ামের ভিত্তি স্তর বা ব্যাসল স্তর থেকেই এই রিজেনারেশন শুরু হয় বা কাজ হয়। সুপারফিসিয়াল স্তরের আবরনী স্তরটি ব্যাসাল স্তরের স্ট্রোমা কোষ এবং লুমিনা কোষ স্তর থেকে গঠিত হয়। ঋতুস্রাবের সময় বের হয়ে যাওয়া বা ঝরে যাওয়া রক্তনালীগুলির স্থানে নতুন করে রক্তনালীকার উৎপত্তি হয়। এন্ডোমেট্রিয়াম এর উপরের স্তর পুনরায় ধীরে ধীরে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। এই সময় এই অংশের বিস্তৃতি ২ মিলিমিটার হয়।

২. প্রলিফারেটিভ ফেজ--
-----------------------------
ঋতুচক্রের পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিন থেকে ওভিউলেশন হওয়ার আগের সময় কালকে প্রলিফারেটিভ ফেজ ধরা হয়। ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে এই সময় এন্ডোমেট্রিয়াম এ কিছু পরিবর্তন ঘটে। এই সময় এন্ডোমেট্রিয়ামের সুপারফিসিয়াল স্তরের সার্বিক বৃদ্ধি ঘটে। এই বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি প্রথমদিকে খুব ধীরে ধীরে ঘটলেও পড়ে খুব দ্রুত ঘটে।এই সময়ে এই অংশের কোষগুলি মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে ক্রমশ সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। এন্ডোমেট্রিয়ামের আবরণী স্তরটি বেশ ঘন হয়। এবং সেই আবরণী গুলি ক্রমশ পরস্পর সংলগ্ন হয়ে পড়ে।এন্ডোমেট্রিয়াম এর এই সুপারফিসিয়াল অংশে যে গহ্বর থাকে তাকে এন্ডোমেট্রিয়াম ক্যাভিটি বলে।আবরণী কোষ গুলি পরস্পর সংলগ্ন হয়ে এই সময়ে এই এন্ডোমেট্রিয়াম কাভিটির দিকে মুখ করে থাকে। এই অংশে স্ট্রোমা কোষ স্তর থাকে ,তা এই সময়ে মাকুর মত আকৃতিবিশিষ্ট হয়। এই সময়ে এন্ডোমেট্রিয়ামের ফাংশনাল স্তরে বিস্তৃতি ৩ থেকে ৪ মিলিমিটার হয়। এই সময়ে এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরে প্রচুর পরিমাণ রক্তনালীকার উৎপত্তি হয়। রক্ত নালিকাগুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার জন্য রক্ত নালিকাগুলো ক্রমশ পরস্পর সংলগ্ন হয়,তার জন্য রক্ত নালিকাগুলো থেকে রক্ত বের হয়ে জরায়ুর অভ্যন্তরে চলে আসে। এইভাবে প্রলিফারেটিভ ফেজ শেষ হয়।
৩. সিক্রেটারি ফেজ--
-------------------------
ঋতুচক্রের ১৫ তম দিন থেকে শুরু করে ঋতুস্রাব এর আগে পর্যন্ত সময়কে সিক্রেটারি ফেজ বলে। ওভিউলেশন এরপর কর্পাস লুটিয়াম থেকে যে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় তার প্রভাবের ফলে এই সময় এন্ডোমেট্রিয়ামের সুপারফিসিয়াল স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়।এন্ডোমেট্রিয়ামের উপরিভাগের সুপারফিসিয়াল স্তরের প্রতিটি অংশেই এই সময় বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়।ঋতুস্রাবের ৫-৬ দিন আগে পর্যন্ত এই বৃদ্ধি চলে কিন্তু তারপর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।এই অংশে যে সমস্ত গ্রন্থি থাকে সেগুলি থেকে গ্লাইকোজেন যুক্ত এক ধরনের তরল নিঃসরণ হয়ে থাকে। ওভুলেশনের লক্ষণ হিসাবে এই তরল কে চিহ্নিত করা হয়। ঋতুচক্রের ২১ তম দিন পর্যন্ত এই তরলকে দেখতে পাওয়া যায়।এন্ডোমেট্রিয়ামের স্ট্রোমা কোষগুলিও এই সময় বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ক্রমশ স্ফীত হয়ে ওঠে।
ঋতুস্রাবের ৫ থেকে ৬ দিন আগে এন্ডোমেট্রিয়ামের গ্রন্থির কোষগুলি ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে। তখন এই গ্রন্থির অভ্যন্তরের তরল ক্রমশ বের হয়ে যেতে থাকে। ঋতুস্রাবের ১ থেকে ২ দিন আগে এন্ডোমেট্রিয়ামের ব্যসাল স্তরের সংকোচন আরম্ভ হয়। এন্ডোমেট্রিয়াম এই স্তরে যে অসংখ্য রক্তনালিকে থাকে সেগুলো এই সংকোচনের ফলে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সংকোচনের জন্য রক্ত নালিকাগুলো থেকে রক্তস্রাব শুরু হয়।
৪. মেনস্ট্রুয়াল ফেজ--
---------------------------
গর্ভ অবস্থার জন্য প্রস্তুত হওয়া এন্ডোমেট্রিয়াম গর্ভধারণের অভাবে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। এই সময়কালে এন্ডোমেট্রিয়ামের প্রত্যেকটি অংশ তার পূর্বেকার অবস্থায় ফিরে আসে। এই সময় পরই নতুন ঋতুচক্র শুরু হয়।এন্ডোমেট্রিয়াম এর প্রত্যেকটি অংশই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবার ফলে ইস্ট্রোজেন প্রজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রাও কমে যায়।সেই জন্য হরমোনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়ামের যে সমস্ত পরিবর্তন হয় তা বন্ধ হয়ে যায়।আগেই বলেছি এন্ডোমেট্রিয়ামের সুপারফিসিয়াল স্তরের রক্তবাহিকা নালিকাগুলো সংকোচনের ফলে সেখান থেকে রক্ত স্রাব হতে শুরু করে। এই রক্তস্রাব ঋতুস্রাবে পরিণত হয়।এন্ডোমেট্রিয়ামের স্তর গুলি ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ঋতুস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যেতে থাকে।রক্তবাহী নালীকার সংকোচনের ফলে শিরা-ধমনীর ভিতরে দেওয়ালগুলো ভেঙে যেতে থাকে ফলে সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ রক্ত বের হয়ে আসতে থাকে। জরায়ুর অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বাধলেও প্লাসমিন দ্বারা তা আবার তরলে পরিণত হয়।যেহেতু এন্ডোমেট্রিয়ামের শিরা ধমনী গুলি বিদীর্ণ হবার জন্য ঋতুস্রাব হয়, তাই শিরা-ধমনীর সংকোচন বন্ধ হলেই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।এজন্য ঋতুস্রাবের দ্বিতীয় দিনেই এন্ডোমেট্রিয়ামের সুপারফিসিয়াল অংশের প্রায় অর্ধেক অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় জরায়ুর অভ্যন্তরে পতিত হয় এবং তা ঋতুস্রাব এর মাধ্যমে বের হয়ে যায়।ঋতুস্রাবের তৃতীয় দিনে এন্ডোমেট্রিয়ামের যে বিভিন্ন গ্রন্থি থাকে সেগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ঋতুস্রাব এর মাধ্যমে দেহ থেকে বের হয়ে যায়।অবশ্য ঋতুস্রাবের দ্বিতীয় দিনের পর থেকেই এন্ডোমেট্রিয়ামের ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার প্রক্রিয়া টি আর দ্রুত গতিতে সংঘটিত হয় না।
যদি পুরুষের দেহ হতে আসা শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়, তাহলে তা জরায়ুতে নেমে আসে। জরায়ুর গাত্রে প্রথমে নিষিক্ত ডিম্বানুটি প্রোথিত হয়।জরায়ুর গাত্রে এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরে ঋতুচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে রক্ত সঞ্চয়ের কারণ হলো যদি নিষিক্ত ডিম্বানুটি জরায়ুর গাত্রে নেমে আসে, তাহলে সেই ডিম্বাণুটি এন্ডোমেট্রিয়ামের গাত্রে সৃষ্টি হওয়া অসংখ্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শিরা ধমনী দ্বারা সেখানে যাতে ভালোভাবে প্রোথিত হতে পারে। পরে এই শিরা ধমনী থেকেই অমরা বা প্লাসেন্টা তৈরি হয়।

আর যদি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন না হয় অর্থাৎ যদি নিষেক না হয় তবে ২৪ ঘন্টা পর ডিম্বাণুর মৃত্যু ঘটে। ডিম্বাণু মৃত্যু হওয়ার পরেই জরায়ুতে নেমে আসে।জরায়ু গাত্রে যে সমস্ত মিউকাস স্তর থাকে এবং জরায়ু গাত্রে যে সমস্ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কলা স্তর থাকে তা মৃত ডিম্বাণুটি সহ জরায়ু থেকে বের হয়ে আসে। একটা কথা বলা যেতেই পারে যে, জরায়ু গর্ভধারণ না করতে পারলেই ঋতুস্রাব হয়। তাই বলা যেতে পারে যে জরায়ুর গর্ভধারণের ব্যর্থতার প্রমাণ হলো ঋতুস্রাব। গর্ভধারণ না করতে পেরে ব্যর্থ জরায়ুর কান্নাই হলো ঋতুস্রাব। ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে weeping of the uterus. অর্থাৎ জরায়ুর কান্নাই হলো ঋতুস্রাব। শুধুমাত্র গর্ভাবস্থায় ও শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময় ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে সুস্থ স্বাভাবিক ও শারীরবৃত্তিয় ভাবে।
লেখকঃ
ডাঃ কুশাল কুন্ডু। (Drkushal kundu.)
(সংকলিত)
আমার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিষয়ক সকল লেখা একসাথে পড়ুন।এপসটি ডাউনলোড করুন,আপডেট নিন।আমার মোবাইল এপস লিঙ্ক ঃ

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.aslamconsole.android.evahomeohall&fbclid=IwAR3mHp4BauqONW3oiO3eVCVTaCqrsPvcY5Z4qq3826ps_Avf6-wN-SixmEg

ডাঃ ইয়াকুব আলী সরকার
ইভা হোমিও হল।
বাইপাইল,সাভার,ঢাকা।
মোবাইল নং ০১৭১৬৬৫১৪৮৮।
গভঃ রেজিঃ নং ২৩৮৭৬।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন